মরুভূমি সাধারণভাবে শুষ্ক, রুক্ষ, প্রাণহীন
সাধারণভাবে শুষ্ক, রুক্ষ, প্রাণহীন
মরুভূমি
সাধারণভাবে শুষ্ক, রুক্ষ, প্রাণহীন এলাকাকে মরুভূমি (Desert) বলা হয় । আরও সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায়, যে এলাকায় বার্ষিক বৃষ্টিপাত ২৫০ মিলিমিটারের নিচে এবং প্রাণী ও উদ্ভিদের বসবাস খুব কম, সেটাই মরুভূমি ।
প্রাণী ও উদ্ভিদের পরিমাণ খুব কম থাকায় ভূতত্ত্ববিদেরা মেরু এলাকাকেও মরুভূমির অন্তর্ভুক্ত করেছেন, সেখানে প্রচুর পানি বরফ হয়ে জমে আছে । সব মহাদেশেই মরুভূমি রয়েছে । মরুভূমিতে উদ্ভিদ ও প্রাণীর সংখ্যা খুব কম । প্রতিটি মরুভূমির রয়েছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ।
যদিও
চিলির আতাকামা মরুভূমি পৃথিবীর সবচেয়ে শুষ্ক মরুভূমি। অ্যান্ডিজ পবর্তমালার কারণে এখানে বাৎসারিক বৃষ্টির পরিমাণ মাত্র ১ মিলিমিটার খুবই রুক্ষ ও প্রাণহীন ।
মরুভূমির প্রকৃতি ও পরিবেশ
এখানকার বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ খুব কম, মাটিতেও পানি নেই বললেই চলে । বায়ু খুব বেশি তাপ গ্রহণ করে না বলে ভূপৃষ্ঠ এবং এর কাছাকাছি বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা ৫৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠে যায় ।
খুব গরম হলেও বায়ুর আর্দ্রতা এখানে বেশ কম। এ কারণে অতিরিক্ত তাপ থেকে শরীরকে রক্ষা করতে মরুভূমির মানুষ মোটা কাপড়ের পোশাক পরে । আবার দিনের বেলা গ্রহণ করা তাপ রাতে ছেড়ে দেওয়ায় মরুভূমিতে তাপমাত্রা অনেক কমে যায় । আফ্রিকার সাহারা বা চীনের গোবি মরুভূমিতে এমন পরিবেশ দেখা যায় । এ ধরনের মরুভূমির প্রধান উপাদান বালি ।
কিছু কিছু মরুভূমি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে অনেক উঁচুতে অবস্থিত । হিমালয় পর্বতের উত্তর দিকে জম্মু ও কাশ্মীর অঞ্চলের মরুভূমির উচ্চতা প্রায় দশ হাজার ফুট । এত উচ্চতায় জলীয় বাষ্প পৌঁছায় না বলে তেমন বৃষ্টি হয় না । এ মরুভূমি কিন্তু উষ্ণ নয়, বরং অনেক ঠান্ডা ।
একই রকম ঠান্ডা থাকে মেরু এলাকায় এবং এন্টার্কটিকা মহাদেশের মরুভূমিগুলোতে । সেখানকার মাটি ও পানি বরফে ঢাকা থাকে বলে উদ্ভিদ বাঁচতে পারে না ।
সৃষ্টি রহস্য
সূর্য বিষুবরেখা বরাবর পৃথিবীতে আলো ও তাপ দেয় । ফলে এ এলাকায় বাতাস সব সময় গরম থাকে । বাতাস গরম হয়ে উপরে উঠে যায় এবং পৃথিবীর উত্তর ও দক্ষিণ দিকে এগিয়ে যায় । এই উত্তর ও দক্ষিণমুখী উষ্ণ বায়ুপ্রবাহ উত্তর ও দক্ষিণ গোলার্ধে দুটি 'মরুভূমি বলয়' তৈরি করেছে ।
এই বলয়ে উত্তর গোলার্ধে আছে চীনের গোবি, উত্তর আমেরিকার দক্ষিণ-পশ্চিমাংশ, উত্তর আফ্রিকার সাহারা মরুভূমি এবং মধ্যপ্রাচ্যের আরব এবং ইরান মরুভূমি । অন্যদিকে দক্ষিণ গোলার্ধে আছে আর্জেন্টিনার পাতাগোনিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকার কালাহারি এবং অস্ট্রেলিয়ার গ্রেট ভিক্টোরিয়া ও গ্রেট স্যান্ডি মরুভূমি ।
এ ছাড়া মেরু এবং এন্টার্কটিকা অঞ্চল থেকে ঠান্ডা পানির প্রবাহ বিষুবরেখার দিকে বয়ে যায় । মরুভূমিতে উদ্ভিদের সংখ্যা অনেক কম বায়ুপ্রবাহ এ পানির প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করে ।
এ ধরনের ঠান্ডা বায়ুপ্রবাহে কুয়াশা তৈরি হয়, কিন্তু বৃষ্টি হয় খুব কমই । ফলে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়া, দক্ষিণ-পশ্চিম আফ্রিকা এবং চিলিতে মরুভূমি তৈরি হয়েছে ।
পাহাড়ের কারণেও মরুভূমি তৈরি হয় । উষ্ণ ও আর্দ্র বায়ু পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে জলীয় বাষ্প ছেড়ে দেয় এবং তখন সেখানে বৃষ্টি হয় । পরে সেই শুষ্ক বায়ু মাটি থেকে জলীয় বাষ্প সংগ্রহ করে, যার ফলে মাটিতে পানির পরিমাণ কমে যায় ।
উত্তর আমেরিকার গ্রেট বেসিন মরুভূমি এভাবেই তৈরি হয়েছে । গাছপালা থাকে না বলে মরুভূমিতে যে বৃষ্টি হয়, তা সহজেই বাষ্পে পরিণত হয় । এ কারণে মরুভূমি বহু বছর টিকে থাকে ।
মরুর উদ্ভিদ
মরুভূমিতে পানির পরিমাণ খুব অল্প । ফলে সেখানে উদ্ভিদের সংখ্যাও খুব কম । মরুভূমির উদ্ভিদের মধ্যে এমন কিছু বৈশিষ্ট্য আছে, যেগুলো কাজে লাগিয়ে এরা খুব কম পানি নিয়েও বেঁচে থাকে । যেমন, মরুভূমির ফুলেল উদ্ভিদ অল্প দিনের জন্য বাঁচে । তবে তাদের বীজ মাটিতে কয়েক বছরের জন্য সুপ্ত অবস্থায় থাকে । প্রয়োজনীয় পরিমাণ বৃষ্টি হলে ওই বীজ থেকে গাছ হয় ।
মরুভূমির বড় বড় উদ্ভিদের দুই ধরনের মূল থাকে । কিছু উদ্ভিদের মূল অনেক বড় ও গভীর হয়, ফলে মাটির নিচ থেকে উদ্ভিদ পানি সংগ্রহ করতে পারে । আবার কিছু কিছু উদ্ভিদের মূল ছড়ানো ও অগভীর হয় । এরা মাটির উপরের কুয়াশা ও বৃষ্টি থেকে পানি সংগ্রহ করে ।
মরু উদ্ভিদের পাতা ছোট হয়, ফলে এরা শ্বসনের মাধ্যমে বেশি পানি ত্যাগ করে না । কিছু উদ্ভিদ শুষ্ক মৌসুমে পাতা ঝেড়ে ফেলে । অনেক উদ্ভিদের দেহে আবার পাতা বদলে গিয়ে কাঁটায় পরিণত হয় (যেমন, ক্যাকটাস)।
মরুভূমির উল্লেখযোগ্য একটি উদ্ভিদ হলো ক্যাকটাস। এর গায়ে পাতার বদলে কাঁটা থাকে । দিনের অতিরিক্ত তাপ থেকে রক্ষা পেতে মরুপেঁচা ক্যাকটাস গাছে লুকিয়ে থাকে।
মরুভূমিতে প্রায়ই ধূলিঝড় দেখা যায়। উঁচু স্তম্ভের মতো বালি মেশানো বাতাস ঘুরতে ঘুরতে সামনে এগিয়ে যায়। সাহারা ও আরব মরুভূমিতে ঘূর্ণিঝড়ের উচ্চতা ২০০ মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে। এটি 'সাইমুম (Simoom) নামে পরিচিত।
মরুপ্রাণ
মরুভূমিতে প্রাণীর সংখ্যা বেশ কম, তবে অনেক বৈচিত্র্য আছে । উদ্ভিদের মতো মরুর প্রাণীরা এমনভাবে বিবর্তিত হয়েছে যে, এরা কম পানি পান করেই বেঁচে থাকতে পারে । শুষ্ক মৌসুমে মরুর প্রাণীরা শীতনিদ্রায় চলে যেতে পারে । তারপর যখন বৃষ্টি আসে, তখন তারা দ্রুত সক্রিয় হয়ে যায় এবং ডিম পাড়ে বা বাচ্চা প্রসব করে।
খাবারের জোগান কম হওয়ায় এদের খাদ্য গ্রহণেও রয়েছে বৈচিত্র্য । উত্তর আমেরিকার ক্যাঙারু ইঁদুর এবং আফ্রিকার জারবিল শুষ্ক বীজ খেয়ে বেঁচে থাকে । এদের পরিপাক ক্ষমতা খুব ভালো, ফলে খাবার থেকে বেশি পুষ্টি গ্রহণ করতে পারে ।
আবার কিছু মরু অঞ্চলের প্রাণী বরফ মরুভূমিতে জমাট বাঁধা পানি আছে প্রচুর, কিন্তু প্রাণ নেই বললেই চলে।
খুব কম পানি বাষ্পায়িত হয় বলে মরুভূমির মাটিতে নানা খনিজ পদার্থ থাকে। যেমন, চিলির আতাকামা মরুভূমিতে রয়েছে। সোডিয়াম নাইট্রেট-এর বিশাল ভান্ডার। যুক্তরাষ্ট্রের গ্রেট বেসিন মরুভূমি থেকে প্রচুর খনিজ তোলা হয়, যা কাচ, রং, আঠা, রাসায়নিক ইত্যাদি শিল্পক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়।
পানিশূন্যতায়ও বেঁচে থাকতে পারে— যেমন উট । উটের মতো আরও কিছু প্রাণীর শরীরে পানি সংরক্ষণের জন্য কুঁজ-জাতীয় জায়গা থাকে । মরুভূমির অধিকাংশ স্তন্যপায়ী প্রাণী। নিশাচর । এরা সহজে দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে । বিপাক (Metabolism) এবং হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন বাড়িয়ে বা কমিয়ে এরা তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে ।
দিনের বেলা বেশি তাপ থেকে দেহকে রক্ষা করতে এরা বালির মধ্যে লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করে । আবার দিনে এরা যে তাপ নেয়, তা রাতের ঠান্ডা আবহাওয়ায় তাদের টিকে থাকতে সাহায্য করে।
কিওয়ার্ড:
- মরুভূমি
- মরুভূমির প্রকৃতি ও পরিবেশ
- সৃষ্টি রহস্য
- মরুর উদ্ভিদ
- মরুপ্রাণ
এসা বিডি ডটকম এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url