ভূমিকম্প ও এর পরিণাম

ভূমির কম্পনকেই বলা হয় ভূমিকম্প (Earthquake) । এটি এক ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ । এ দুর্যোগে কিছু সময়ের জন্য মাটির নিচের শিলাস্তর কেঁপে ওঠে । মাটির উপরে থাকা দালান-কোঠা, প্রাণী ও উদ্ভিদজগতের মধ্যে সেই কম্পন ছড়িয়ে পড়ে


ভূমিকম্প ও এর পরিণাম

কখনো কখনো এই কম্পন এতই শক্তিশালী হয় যে বহু বাড়ি-ঘর ভেঙে পড়ে এবং মানুষসহ অন্যান্য প্রাণী আহত বা নিহত হয় । শক্তিশালী ভূমিকম্প তার উৎপত্তিস্থল থেকে অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়তে পারে । কখনো কখনো ভূমিকম্পের ফলে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত এবং সুনামি হয়ে থাকে ।



এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি মাত্রার ভূমিকম্প হয়েছিল চিলিতে, ১৯৬০ সালে। এতে প্রায় দশ হাজার লোক মারা যায় এবং সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়। এই ভূমিকম্পের ফলে বিরাট এলাকাজুড়ে সুনামিও হয়েছিল


কেন এই কম্পন

ভূপৃষ্ঠ ও এর ভেতরের অংশ এক বিশাল শক্তির আধার । এটি বেশ কিছু শিলাস্তর বা ভাঁজের সমষ্টি । এই ভাঁজগুলো গরম, গতিশীল এবং শক্তিসম্পন্ন । কখনো কখনো এই শিলাস্তরে ভাঙন হয় বা ভাঁজে ভাঁজে সংঘর্ষ হয় । তখন পৃথিবীর নিচে জমে থাকা বিপুল শক্তি মুক্ত হয়ে যায় এবং ভূপৃষ্ঠে ঝাঁকুনি বা কম্পনের সৃষ্টি করে ।



একটি শান্ত পুকুরে ঢিল ছুড়লে ঢিলটি পানিতে ঢেউয়ের সৃষ্টি করে এবং সে ঢেউ পুকুরের চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে । একইভাবে ভূমিকম্পের ক্ষেত্রেও মাটির গভীরে যেখানে শক্তি নির্গত হয়, সেখান থেকে শিলাস্তরে বা পৃথিবীর বিভিন্ন ভাঁজে সে তরঙ্গ দ্রুত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে ।


দুটো ভাঁজের মাঝের ভাঙনকে বলা হয় ফাটল (Fault) সাধারণত ফাটলেই ভূমিকম্প হয়ে থাকে । এ ছাড়া আগ্নেয়গিরির লাভা প্রচণ্ড শক্তিতে মাটির নিচ থেকে বের হয়ে আসার সময়ও ভূমিকম্পের সৃষ্টি হয় ।


মাটির গভীরে যেখানে শক্তি মুক্ত হয়। তাকে বলে কেন্দ্র (Focus)। কেন্দ্র থেকে লম্বালম্বিভাবে ভূপৃষ্ঠের উপরের স্থানটি ভূকম্পন বিন্দু বা উপকেন্দ্র (Epicenter) নামে পরিচিত। উপকেন্দ্রের আশপাশের অঞ্চলেই ভূমিকম্প সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী হয়ে থাকে ।


২০১০ সালের ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত হাইতির জাতীয় কংগ্রেস ভবন



ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা

ভূমিকম্পের ঝুঁকি পৃথিবীর সর্বত্র সমান নয় । বেশির ভাগ ভূমিকম্প পৃথিবীর প্রশান্ত মহাসাগর উপকূল এলাকাজুড়ে হয়ে থাকে । কারণ, প্রশান্ত মহাসাগরের নিচের প্লেট বা শিলাস্তর প্রতিনিয়ত সংকুচিত হচ্ছে । এ এলাকার প্লেটের গতি অন্য প্লেটগুলোর চেয়ে বেশি ।


প্রশান্ত মহাসাগরে অবস্থিত দক্ষিণ ও উত্তর আমেরিকার পশ্চিম উপকূল, জাপান, চীন,পূর্ব রাশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকম্প হয়ে থাকে ।


ভূমিকম্পের পরিমাপ ভূমিকম্পের শক্তি বা তরঙ্গ পরিমাপের জন্য যে যন্ত্র ব্যবহার করা হয় তার নাম ভূকম্পলিখন যন্ত্র বা সাইসমোগ্রাফ (Seismograph) । এই যন্ত্রে একটি বস্তু স্প্রিংয়ে ঝোলানো থাকে । এই স্প্রিংটি খুব হালকা কম্পনও পরিমাপ করতে পারে ।


পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে এক হাজারেরও বেশি সাইসমোগ্রাফ যন্ত্র বসানো আছে । একটি মূল স্টেশন থেকে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা হয় । প্রতিটি যন্ত্র তার নিজ এলাকার ভূমিকম্পের মাত্রা নির্ণয় করে মূল স্টেশনে পাঠিয়ে দেয় ।


এখান থেকে পাওয়া তথ্য নিয়ে মূল স্টেশন নির্ধারণ করে, ভূমিকম্পের উপকেন্দ্র ও উৎপত্তিস্থল কোথায় ছিল ।


সাইসমোগ্রাফ যন্ত্র থেকে পাওয়া কম্পন বা ভূমিকম্পের মাত্রাকে লগারিদমিক স্কেলে প্রকাশ করা হয় । একে বলা হয় রিখটার স্কেল। এ স্কেলের মান ০ থেকে ১০ এর মধ্যে হয়ে থাকে । এ স্কেলে তিন মাত্রার ভূমিকম্পের চেয়ে চার মাত্রার ভূমিকম্প দশগুণ এবং পাঁচ মাত্রার ভূমিকম্প ১০০ গুণ বেশি এলাকায় কার্যকর হয় ।


আবার মাত্রা এক বৃদ্ধি পাওয়ার অর্থ হলো, ভূমিকম্পের ফলে যে শক্তি বের হয়ে আসে তা আগের মাত্রার চেয়ে বত্রিশ গুণ বেশি।


ভূমিকম্পে সাধারণত দুটি তরঙ্গ তৈরি হয়- প্রাথমিক তরঙ্গ (P wave) এবং মাধ্যমিক তরঙ্গ (S wave)। প্রাথমিক তরঙ্গ অনুভূত হওয়ার কিছুক্ষণ পর মাধ্যমিকটি বোঝা যায়। ধীরগতির হলেও এটিই বেশি শক্তিশালী। এ ছাড়া আরও এক ধরনের তরঙ্গ আছে যাকে বলা হয়
পৃষ্ঠ তরঙ্গ (Surface wave) 

সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় চীনের তাংশানে ১৯৭৬ সালের ভূমিকম্পে। সে সময় প্রায় আড়াই লাখ মানুষ মারা যায় ।

ক্ষয়ক্ষতি

ভূমিকম্প একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ । এটি মাঝে মাঝেই পৃথিবীর বিভিন্ন এলাকায়। ব্যাপক প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায় । ভূমিকম্পের প্রচণ্ড শক্তি ভূপৃষ্ঠে যে ঝাঁকুনির সৃষ্টি করে, তাতে মাটি ঢেউয়ের মতো একবার উপরে উঠে নিচে নামে, আবার একপাশ থেকে আর একপাশে সরে যায় ।


ভূমিকম্পের ঝাঁকুনির তীব্রতা ও শক্তির পরিমাণের উপর নির্ভর করে কোনো এলাকায় ধ্বংসের মাত্রা । তা ছাড়া ভূকম্পন এলাকার শিলার প্রকৃতি ও ঘরবাড়ির নির্মাণ কাঠামোর উপরও এর ধ্বংসযজ্ঞ নির্ভর করে ।


ভূমিকম্পের ফলে ভূপৃষ্ঠের কোথাও ফাটল বা ধ্বংসের সৃষ্টি হয় এবং নদীর গতিপথ পাল্টে যায় । যেমন ১৭৮৭ সালে আসামে যে ব্যাপক ভূমিকম্প হয়, তাতে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদীর তলদেশ কিছুটা উঁচু হয়ে যায় । এই ভূমিকম্পের ফলেই ব্ৰহ্মপুত্র থেকে যমুনা। নদীর উৎপত্তি হয় ।


ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় ভূমিকম্পের ফলে ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি হয় । ভূমিকম্পে এ ধরনের এলাকায় ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, পানি, গ্যাস সরবরাহ ও অন্যান্য সম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হয় । ভূমিকম্পের কারণে অনেক সময় আগুন ছড়িয়ে পড়ে তা ছাড়া এলাকাটি পাহাড়ি হলে সেখানে পাহাড় বা ভূমিধস হয়, যা ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে ।


সমুদ্রও ভূমিকম্পের প্রভাব এড়াতে পারে না। ভূকম্পন সমুদ্র তলদেশে হলে তা উপরের পানিতে বিশাল ঢেউয়ের সৃষ্টি করে, যা সুনামি নামে পরিচিত






এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এসা বিডি ডটকম এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ১

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ৭

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ৩

এইটা একটি বিজ্ঞাপন এরিয়া। সিরিয়ালঃ ৭