পারমাণবিক শক্তি কি রুপপুর পারমাণবিক চুল্লি কিভাবে চলে ?
ভূমিকা:
ভূমিকা:পারমাণবিক শক্তি একটি ব্যাপক ও বিস্তারিত বিষয় যা বিশ্লেষণ করলে কোন কিছুর অনু ,পরমাণু , ফিউশন বিক্রিয়া, ফিউশন প্রক্রিয়া ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে হয়। যা আমরা ধাপে ধাপে নিচে বর্ণনা করছি।পারমাণবিক শক্তি এমন একটি শক্তি যা দিয়ে এটম বোম থেকে শুরু করে পারমাণবিক চুল্লি বিভিন্ন ধরনের বৃহৎ শক্তির আধার তৈরি করা সম্ভব। পারমাণবিক শক্তির অতীত ইতিহাস ও বর্তমান এবং এর গঠন ক্রিয়া বিক্রিয়া প্রক্রিয়া সমস্ত কিছুই আমার এই আর্টিকেলে লেখা হয়েছে । আশা করি বিস্তারিত পড়লে ভালো বুঝতে পারবেন।
পারমাণবিক শক্তি
পারমাণবিক শক্তিপরমাণু হলো অতি ক্ষুদ্র কণা, যা দিয়ে সব বস্তু তৈরি হয়েছে । এটি এতই ছোট যে, একটি বিন্দুতে ৪০০ কোটি পরমাণু থাকে । পরমাণুর কেন্দ্রে থাকে নিউক্লিয়াস যাতে পরমাণুর প্রায় সমস্ত ভর কেন্দ্রীভূত থাকে । নিউট্রন ও প্রোটন দিয়ে গঠিত হয় নিউক্লিয়াস ।
প্রচুর পরিমাণ শক্তি নিয়ে নিউট্রন ও প্রোটন নিউক্লিয়াসে একত্র থাকে । এই শক্তিই পারমাণবিক শক্তি (Atomic Energy) নামে পরিচিত । পরমাণুর ভেতরে থাকা এই শক্তিই সূর্যের আলো ও তাপের উৎস । এ শক্তির সাহয্যে বিধ্বংসী বোমা যেমন তৈরি করা যায় তেমনি বিদ্যুৎ উৎপাদনের মতো শান্তিপূর্ণ কাজেও এটি ব্যবহার করা যায় ।
পরমাণুর ভাঙন
পরমাণুর ভাঙনপারমাণবিক শক্তি তৈরির জন্য যে উপাদানটি বেশি ব্যবহৃত হয়, সেটা হলো ইউরেনিয়াম নামের একটি মৌল। মৌলটির নিউক্লিয়াস ভেঙে গেলে পারমাণবিক শক্তি পাওয়া যায়। এই ধরনের প্রক্রিয়া ফিশন শৃঙ্খল বিক্রিয়া (Fission Chain Reaction) নামে পরিচিত। যেকোনো সাধারণ রাসায়নিক বিক্রিয়ার চেয়ে পারমাণবিক বিক্রিয়ায় অনেক বেশি শক্তি তৈরি হয়। যেমন, এক কিলোগ্রাম ইউরেনিয়াম থেকে ৩০০০,০০০ কিলোগ্রাম কয়লার সমপরিমাণ শক্তি পাওয়া যায়।
👌 ফিশন বিক্রিয়া যেভাবে ঘটে 👌
১৯৪২ সালে ফার্মি প্রথম নিউক্লিয়ার রিয়েক্টরে নিয়ন্ত্রিত ফিশন বিক্রিয়ার ঘটাতে সক্ষম হন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই প্রচণ্ড শক্তির প্রথম সফল ব্যবহার হয় বোমা তৈরিতে। ১৯৪৫ সালে প্রথম পারমাণবিক বোমার আবিষ্কার ও ব্যবহার হয়। প্রথম দিকের বোমাগুলোতে ইউরেনিয়াম অথবা প্লুটোনিয়াম নামের তেজস্ক্রিয় পদার্থকে ফিশন পদ্ধতিতে ভেঙে বিস্ফোরণ ঘটানো হতো। এটি পারমাণবিক বোমা (Atomic Bomb) নামে পরিচিত ছিল। এরপর হাইড্রোজেন গ্যাসের পরমাণু একত্র করে ফিউশন পদ্ধতিতে তৈরি হয় উচ্চতাপের বোমা, যা হাইড্রোজেন বোমা নামে পরিচিত ।
আসলে শৃঙ্খল বিক্রিয়া কি ?
আসলে শৃঙ্খল বিক্রিয়া কি ?ফিশন বিক্রিয়ায় একটি নিউট্রন কণা। ইউরোনিয়াম নিউক্লিয়াসকে আঘাত করে দুই ভাগে ভাগ করে এবং এর ফলে নিউট্রন ও শক্তি উৎপন্ন হয়। উৎপন্ন নিউট্রন কণা আবার অন্য একটি ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াসকে আঘাত করে। এভাবে প্রতিটি নিউট্রন কণা ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াসকে ক্রমান্বয়ে আঘাত করে নিউট্রন ও শক্তি উৎপাদন করতে থাকে। এ কারণে এটাকে বলা হয় চেইন বা শৃঙ্খল বিক্রিয়া।
👌 পারমাণবিক বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ 👌
👌 পারমাণবিক বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ 👌
ইতিহাস
ইতিহাসপারমাণবিক শৃঙ্খল বিক্রিয়ার ধারণা প্রথম দিয়েছিলেন হাঙ্গেরির বিজ্ঞানী লিও জিলার্ড (Leó Szilárd, 1898–1964), ১৯৩৩ সালে। তিনি এই ধারণাটিকে পেটেন্টও করিয়েছিলেন। ১৯৩৪ সালে রাশিয়ার পদার্থবিজ্ঞানী এন এন সেমিয়োনভ জিলার্ডের ধারণাটিকে পরিমার্জিত করেন। তবে তখনো তাঁদের দুজনের কেউই বাস্তবে পারমাণবিক শৃঙ্খল বিক্রিয়া ঘটিয়ে দেখাতে। পারেননি। সেটা প্রথম করেছিলেন ইতালির এনরিকো ফার্মি (Enrico Fermi, 1901 - 1954), ১৯৩৯ সালে। তাঁর সাথে ছিলেন লিও জিলার্ড, জার্মানির বিজ্ঞানী ফ্রেডারিখ স্ট্র্যাসম্যান (Friedrich Wilhelm Strassmann, 1902-1980) ও অটো হ্যান (Otto Hahn, 1879–1968)। তাঁরা দেখিয়েছিলেন যে, ইউরেনিয়াম নিউক্লিয়াসকে ভেঙে শক্তি উৎপাদন সম্ভব।
👌 যে প্রকল্পের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র প্রথম পারমাণবিক বোমা তৈরি করে, তার নাম ম্যানহাটান প্রকল্প। এ প্রকল্পের দায়িত্বে ছিলেন মার্কিন বিজ্ঞানী ওপেনহাইমার (Julius Robert Oppenheimer, 1904-1967) 👌
আসলে ফিউশন বিক্রিয়া কি ?
আসলে ফিউশন বিক্রিয়া কি ?পৃথিবীর সব প্রাণী সূর্যের আলো ও তাপের উপর নির্ভরশীল । যে শক্তির সাহায্যে সূর্য নিজে আলোকিত হয়ে সৌরজগতের অন্য গ্রহগুলোকে আলোকিত করে, সেটাও কিন্তু পারমাণ- বিক শক্তি । সূর্যে প্রচুর পরিমাণে হাইড্রোজেন গ্যাস আছে । যখন দুটি হাইড্রোজেন পরমাণু একত্র হয় তখন | হিলিয়াম গ্যাস এবং বিপুল পরিমাণ পারমাণবিক শক্তি উৎপন্ন হয় । যেহেতু এখানে পরমাণু একত্র হয়, তাই এই বিক্রিয়ার নাম ফিউশন শৃঙ্খল ক্রিয়া (Fusion Chain Reaction)।
বিজ্ঞানীরা ইতিমধ্যেই ফিউশন—বিক্রিয়া ব্যবহার করে বিধ্বংসী হাইড্রোজেন বোমা তৈরি করেছেন। এর ধ্বংসকারী ক্ষমতা সাধারণ বিস্ফোরকের তুলনায় লক্ষ গুণ বেশি। তবে বিজ্ঞানীরা এখনো ফিউশন—বিক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণের পর্যায়ে আনতে পারেননি। ফলে ফিউশন বিক্রিয়া ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন এখনো সম্ভব হয়নি।
✌ ১৯৫৪ সালে রাশিয়ার অবনিন্স্ক শহরে প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনকেন্দ্র চালু হয় ✌
পারমাণবিক শক্তির বিপদ
পারমাণবিক শক্তির বিপদপারমাণবিক শক্তির প্রথম ব্যবহারটাই ছিল ভীষণ ভয়াবহ। ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট ও ৯ আগস্ট দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে যুক্তরাষ্ট্র পারমাণবিক বোমা হামলা করে। এর ফলে তৎক্ষণাৎ মারা যায় প্রায় ২ লাখ মানুষ। আর যারা বেঁচে ছিল তাদেরও অধিকাংশই তেজস্ক্রিয়তার শিকার হয়েছিল। অনেকেই বিভিন্ন দুরারোগ্য অসুখে আক্রান্ত হয়ে ধীরে ধীরে মারা যায়।
বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত পারমাণবিক শক্তিও কম বিপজ্জনক নয় । ১৯৮৬ সালে। ইউক্রেনের চেরনোবিল নামক স্থানে। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে দুর্ঘটনার প্রথম তিন মাসের মধ্যে ৩০ জন মানুষ মারা যায় । পরবর্তী কালে তেজস্ক্রিয়তার কারণে সেখানে বায়ু, মাটি, প্রাণী, উদ্ভিদ ও কৃষির ব্যাপক ক্ষতি হয় । প্রায় তিন লাখ মানুষকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেয়া হয় ।
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রপারমাণবিক শক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ তৈরি করা যায় । গ্যাস বা তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো এখানেও পানিকে গরম করে বাষ্প তৈরি করা হয় এবং সে বাষ্প দিয়ে টারবাইন চালানো হয় । তবে একই পরিমাণ জ্বালানি থেকে অনেক বেশি পারমাণবিক শক্তি পাওয়া যায় বলে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা এক গিগাওয়াট বা এক হাজার মেগাওয়াটেরও বেশি হয়ে থাকে । বর্তমানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ব্যবহার করা হচ্ছে ।
এটি বিষাক্ত গ্যাস তৈরি করে না বলে পরিবেশও দূষিত হয় না । তবে পারমাণবিক বর্জ্য খুব বিপজ্জনক । এই বর্জ্য তেজস্ক্রিয় ক্ষমতাসম্পন্ন । এখান থেকে অদৃশ্য শক্তিশালী তরঙ্গ উৎপন্ন হয়, যা শরীরের জন্য ক্ষতিকর । কিছু কিছু বর্জ্য আছে, যার তেজস্ক্রিয়তা হাজার বছর ধরে টিকে থাকে । পারমাণবিক বর্জ্য সুরক্ষিতভাবে সরিয়ে ফেলতে বিজ্ঞানীরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ।
উপসংহার:
উপসংহার:পারমাণবিক শক্তি পারমাণবিক চুল্লি পারমাণবিক বোম সবকিছুই বিজ্ঞানের আবিষ্কার। তবে বিজ্ঞানের প্রতিটি আবিষ্কারই ভালো এবং মানুষের জন্য কল্যাণকর। তবে হ্যাঁ আমরা যদি প্রতিটা আবিষ্কারের ভালো দিকটা নিয়ে চিন্তাভাবনা এবং গবেষণা করে তার ফল শুভ এবং জাতির জন্য কল্যাণকর। আর যদি এর কুফল এবং নেগেটিভ দিকগুলো নিয়ে চিন্তা গবেষণা করি তাহলে সেটা জাতির জন্য কলঙ্কময় অধ্যায় এবং মানবজাতির জন্য অশুভ সংকেত। এর বাস্তব উদাহরণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানে উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল একটি এটমবোম যা আজও বিশ্ববাসীর বিবেককে নাড়া দেয়। তবে আমরা প্রতিটা আবিষ্কারের পজিটিভ এবং সুন্দর সুফল দিকগুলো নিয়ে গবেষণা ও চিন্তা ভাবনা করলে তা হবে জাতির জন্য কল্যাণ ও মঙ্গল।
এসা বিডি ডটকম এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url