স্যার আইজাক নিউটন (১৬৪২-১৭২৭)
১৬৪২ সালের বড়দিনে আইজাক নিউটন জন্মগ্রহণ করেন। ২৯ বছর বয়সে ইংল্যান্ডের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের পাশে তাঁর নাম যোগ হয়। ১৭২৭ সাল, নিউটন গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। চিকিৎসায় কোন সুফল পাওয়া গেল না। অবশেষে ২০শে মার্চ মহাবিজ্ঞানী নিউটন তাঁর প্রিয় অনন্ত বিশ্বপ্রকৃতির বুকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেলেন।
স্যার আইজাক নিউটন (১৬৪২-১৭২৭)
১৬৪২ সালের বড়দিনে আইজাক নিউটন জন্মগ্রহণ করেন।তাঁর জন্মের পূর্বেই পিতার মৃত্যু হয় । জন্মের সময় আইজাক ছিলেন দুর্বল শীর্ণকায় আর ক্ষুদ্র আকৃতির। বিশ্বের প্রয়োজনেই সৃষ্টিকর্তা তাঁর প্রাণ রক্ষা করেন । বিধবা মায়ের সাথেই নিউটনের জীবনের প্রথম বছর কেটে যায়। এ সময় তাঁর মা বারনাবাস নামে এক ভদ্রলোকের প্রেমে পড়ে তাকে বিবাহ করেন। নববিবাহিত দম্পতির জীবনে শিশু নেহাএ অবাঞ্ছিত বিবেচনা করে মা শিশু নিউটনকে তাঁর দাদির কাছে রেখে যান।
১২ বছর বয়সে নিউটনকে গ্রামের স্কুলে ভর্তি
১২ বছর বয়সে নিউটনকে গ্রামের স্কুলে ভর্তিকরে দেয়া হয়। রুগ্ন থাকা সত্ত্বেও দুষ্টুমিতে পাকা ছিল নিউটন। কিন্তু মেধা ছিল প্রখর। স্কুলে থাকাকালীন সময়েই নিউটন গ্রামের এক হাওয়া কল দেখে কৃত্রিম এক হাওয়া কল তৈরি করেন । অধ্যক্ষ প্রায়ই স্কুলে পৌছতে দেরি করত। একদিন নিউটন বললেন, স্যার, আমি আপনার জন্য একটা ঘড়ি তৈরি করে দিচ্ছি, তাহলে ঘড়ি দেখে ঠিক সময়েই স্কুলে আসতে পারবেন ।
নিউটন ঘড়ি তৈরিনিউটন ঘড়ি তৈরি করলেন। ঘড়ির উপরে থাকত একটা পানির পাত্র। প্রতিদিন নির্দিষ্ট পরিমাণ পানি সেই পাত্রে ঢেলে দেয়া হত। তা থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানি ঘড়ির কাঁটার উপর পড়ত এবং ঘড়ির কাঁটা আপন গতিতে এগিয়ে চলত। এরপর নিউটন তৈরি করলেন এক মজার গাড়ি। পা দিয়েই সে গাড়ি চালানো যেত। নিউটনের দুষ্টুমি বুদ্ধির সাথেও ছিল কিছু আবিষ্কার। নিউটনের সৎ বাবা মারা গেলেন।
নিউটন মায়ের সাথে খামারে কাজমায়ের পক্ষে ক্ষেত-খামার দেখাশুনা সম্ভব না হওয়াতে চৌদ্দ বছর বয়সে নিউটনকে গ্রামের বাড়িতে এনে ক্ষেত-খামারের কাজ শেখাতে লাগলেন । অনিচ্ছা সত্ত্বেও মায়ের ইচ্ছা মেনে নিতে হল নিউটনকে। চাষবাসের কাজ দেখাশুনা করা ছাড়া নিয়মিত বাজারে যেত নিউটন। মায়ের ইচ্ছে বাজারে গিয়ে মাল কেনাবেচার কাজ ভালভাবে শিখে নিবে নিউটন। ভাগ্যক্রমে চাচা উইলিয়াম ভাইপোর জ্ঞানতৃষ্ণায় মুগ্ধ হয়ে নিজের কাছে নিয়ে আসেন। চাচা কেমব্রিজের ট্রিনিটি কলেজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তিনি নিউটনকে আবার স্কুলে ভর্তি করে দেন। এক বছর পর নিউটন ট্রিনিটি কলেজে ভর্তি হন ।
নিউটন অধ্যাবসায়ী ও পরিশ্রমী ছিলেন। মেধাও ছিল প্রখর। অঙ্কে তার মাথা থাকা সত্ত্বেও অঙ্কের প্রতি তাঁর কোন আকর্ষণ ছিল না। প্রকৃতির সৌন্দর্য তাকে মুগ্ধ করত। ১৬৬৫ সালে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। কলেজে ছাত্র থাকাকালীন অবস্থাতে তিনি অঙ্কশাস্ত্রের কিছু জটিল তথ্যের আবিষ্কার করেন বাইনসিয়াল থিওরেম (Bionmial theorem), ফ্রান্সসন (Fluxions) যা বর্তমানে ইন্টিগ্রাল ক্যালকুলাস (Interegal Calculus) নামে পরিচিত। এছাড়া কঠিন পদার্থের ঘনত্ব (The method for Calculating the area of curves or the volume of solids)।
স্যার আইজাক নিউটন এর চিঠি
নিউটন একট চিঠিতে লিখেছেন আমি Fluxions পদ্ধতি উদ্ভাবনের সাথে সাথেই মাধ্যাকর্ষণ শক্তির সম্বন্ধে চিন্তা-ভাবনা করতে শুরু করেছি। ভাবতে অবাক লাগে তখন নিউটনের বয়স মাত্র চব্বিশ বছর। নিউটন চাঁদ ও অন্য গ্রহ-নক্ষত্রের গতি নির্ণয় করতে সচেষ্ট হন। ১৬৬৭ সালে তাঁর কৃতিত্বের জন্য ট্রিনিটি কলেজ তাঁকে ফেলো হিসেবে নির্বাচন করলেন।
তিনি আলোর প্রকৃতি ও তার গতিপথ নিয়ে গবেষণার কাজ শুরু করলেন। তিনি তৈরি করলেন প্রতিফলক টেলিস্কোপ। এর সাহায্যে মহাকাশের গ্রহ-নক্ষত্রকে স্পষ্ট দেখা যায়। টেলিস্কোপটির দৈর্ঘ্য ছিল মাত্র ৬ ইঞ্চি। পরে নিউটন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ট্রিনিটি কলেজে গণিতের অধ্যাপক হিসেবে নির্বাচিত হন।
২৯ বছর বয়সে ইংল্যান্ডের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী
২৯ বছর বয়সে ইংল্যান্ডের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীদের পাশে তাঁর নাম যোগ হয়। সোসাইটির প্রথম সভায় তাঁর আলোকতত্ত্ব নিয়ে প্রবন্ধ পাঠ করলেন। প্রশংসা খ্যাতি কোন কিছুই বৈজ্ঞানিক নিউটনের মনজগতকে স্পর্শ করত না। কিন্তু হঠাৎ করেই নিউটনের করুণ হৃদয়ে প্রেমের ছোঁয়া লাগে। বল নাচের আসরে পরিচয় হয় এক তরুণীর সাথে ভাল লাগে তাকে । হঠাৎ করেই তরুণীর একটি হাত নিজের হাতে টেনে নেন।
তেমনি ভাবে প্রিজম নামে একটি নেহাত কাচ কিনে আনেন একবার । পরবর্তীতে কাচ থেকেই উদ্ভব করেন বর্ণতত্ত্ব। তুচ্ছ জিনিসের মধ্যে থেকেই অসীম রহস্যের সন্ধান-এ বোধ হয় নিউটনের চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। একবার কলেজ ছুটির অবসরে মায়ের কাছে গিয়েছিলেন নিউটন । অনেক সময় ধরে বাগানে ঘুরাঘুরি করতেন তিনি। হঠাৎ করেই চোখের সামনে পড়ল একটি আপেল ।
মুহূর্তে তাঁর মনের কোণে উঁকি মারে এক প্রশ্ন—কেন আপেলটি আকাশে না উঠে মাটিতে এসে পড়ল? এ জিজ্ঞাসাই মানুষের চিন্তার জগতে এক যুগান্তর নিয়ে এল । জন্ম নিল মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্বের । যদিও এ চিন্তার সূত্রপাত হয়েছিল বহু পূর্বেই । নিউটন প্রকাশ করলেন তাঁর কালজয়ী গ্রন্থ (Mathematical Principles of Natural Philosophy)। মানুষ মাধ্যাকর্ষণ শক্তির কথা সামান্য কিছু জানলেও এ বিশ্বভ্রহ্মাণ্ড জুড়ে রয়েছে যে তার অস্তিত্ব সে কথা কেউ জানত না। মাধ্যাকর্ষণ শক্তির এ আকর্ষণই গ্রহ নক্ষত্র পৃথিবীকে একসূত্রে বেঁধে রেখেছে।
বিজ্ঞানের সীমারেখা
তিনি বিজ্ঞানের সীমারেখাকে বিস্তৃত করেছিলেন একজন পদার্থবিদের বস্তু থেকে জ্যোতির্বিদের মহাশূন্যে । তিনিই মানুষের কল্পনাকে চালিত করেছিলেন আপেলের গতি থেকে তারার গতিতে। তিনি নির্জনে সকলের অগোচরে গবেষণা করতেন।
তাঁর নিজস্ব যে জগৎ যেখানে মানুষের কোলাহল নেই, নেই খ্যাতির বিড়ম্বনা, নেই সম্মানের মোহ আছে শুধু বিশ্ব প্রকৃতির সঙ্গে নিজেকে একাত্ম করার সাধনা। আবিষ্কৃত সত্যকে সর্বসাধারণের কাছে প্রকাশ করবেন। শুরু হল পাণ্ডুলিপি রচনা। সমস্ত রাত্রি জেগে নিউটন লিখে চললেন, ভোরবেলায় অল্পক্ষণের জন্য ঘুমিয়ে নিয়ে আবার লিখতেন। চাকর দুপুরের গরম খাবার দিয়ে যেত। প্রায় দিনই যখন তিনি সেই খাবার খেতেন তখন গভীর রাত ।
একদিন রাতে বন্ধুর বাড়িতে তাঁর নিমন্ত্রণ। কাজ করতে করতে পনে পড়ল বন্ধুর বাড়িতে যেতে হবে। তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বার হলেন নিউটন। যখন বন্ধুর বাড়িতে পৌঁছলেন তখন গভীর রাত। চারদিক অন্ধকার । নিউটন বুঝতে পারলেন নিমন্ত্রণ পর্ব আগেই শেষ । বাড়ি ফিরে আবার কাজে বসলেন। রাতে খাওয়ার কথা আর মনে হল না তাঁর ।
এক নিরলস গবেষণার মধ্যে নিউটনএক নিরলস গবেষণার মধ্যে নিউটন প্রমাণ করলেন, If the force varied as the inverse square, the orbit would be an ellipes with the centre of the force in one focus -এ আবিষ্কারের মাধ্যমে মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার কাজ সহজসাধ্য হল। নিউটন নির্ণয় করলেন, চন্দ্র-সূর্যের সঠিক আয়তন। প্রতিষ্ঠা হল মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব-এ তত্ত্বের যাবতীয় বিবরণ তিনি লিখলেন তাঁর প্রিন্সিপিয়া গ্রন্থটিতে।
যখন বই প্রকাশিত হল তখন অধিকাংশ মানুষের কাছেই মনে হল এ বই যেমন জটিল তেমনি দুর্বোধ্য। নিউটনের এক দার্শনিক বন্ধু একদিন নিউটনকে জিজ্ঞেস করলেন, কিভাবে তোমার লেখার অর্থ বোঝা সম্ভব? নিউটন তাঁকে একটি বই-এর তালিকা দিয়ে বললেন, আপনি আগে এ বইগুলো পড়ন তাহলে আমার তত্ত্ব বোঝার কাজ সহজ হবে। ভদ্রলোক তালিকা দেখে বললেন, নিউটনের তত্ত্ব বোঝা আমার সাধ্যের বাইরে। কারণ, প্রাথমিক তালিকার এ বই কটি পড়া শেষ করতে আমার অর্ধেক জীবন কেটে যাবে। কিন্তু নিউটন বলতেন, প্রকৃতপক্ষে লোকে আমার বইকে যতখানি জটিল ভাবে ততখানি জটিল নয়। অঙ্কের কোন গভীর জটিল তত্ত্ব এতে নেই।
Philosophiae naturalis Principia Mathematica প্রকাশিতPhilosophiae naturalis Principia Mathematica প্রকাশিত হয় ১৬৮৭ সালে। ল্যাটিন ভাষায় লেখা বইটি তিন খণ্ডে বিভক্ত। প্রথম খণ্ডে নিউটন গতিসূত্র সম্বন্ধে আলোচনা করেছেন ।তিনটি গতিসূত্র হল- (১) প্রত্যেকটি বস্তু চিরকাল সরলরেখা অবলম্বন করে সমবেগে চলতে থাকে । (২) বস্তুর উপর প্রযুক্ত বল বস্তুর ভরবেগের পরিবর্তনের হারের সমানুপাতিক এবং বল যেদিকে ক্রিয়া করে, ভরবেগের পরিবর্তনও সেদিকে ঘটে। (৩) প্রত্যেকটি ক্রিয়ার সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। প্রিন্সিপিয়া গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে তিনি গ্যাস, ফ্লুইও বস্তুর গতির কথা আলোচনা করেছেন। গ্যাসকে কতকগুলো স্থিতিস্থাপক অণুর সমষ্টি ধরে নিয়ে তিনি বয়েলের সূত্র প্রমাণ করেন। তৃতীয় খণ্ডে মাধ্যাকর্ষণ তত্ত্ব সম্বন্ধে খুঁটিনাটি আলোচনা করেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন মধ্যাকর্ষণ শক্তির প্রভাবেই সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে চন্দ্র।
দুটি বস্তুর মধ্যে মহাকর্ষীয় বল তাদের ভরের সমানুপাতিক ও দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিকদুটি বস্তুর মধ্যে মহাকর্ষীয় বল তাদের ভরের সমানুপাতিক ও দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক। পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব পৃথিবীর ব্যাসার্ধের ৬০ গুণ। এ দূরত্ব থেকে চাঁদ পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে। নিউটল লক্ষ্য করেছিলেন সূর্য ও গ্রহগুলোর মধ্যে প্রত্যেকটি গ্রহ ও তাদের উপগ্রহগুলোর বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ১০০ মনীষী মধ্যে পৃথিবীর সমুদ্র ও চাঁদ এবং সূর্যের মধ্যে এমনকি জোয়ার-ভাটা ও সাধারণভাবে জগতের যে কোন দুটি বস্তুর মধ্যে একই মহাকর্ষ তত্ত্ব কার্যকরী ।
গ্রিন্সিপিয়া গ্রন্থটি আর্থিক কারণে ইংল্যান্ডের রয়াল সোসাইটি প্রকাশ করতে পারেনি। এ বই প্রকাশ করেন এডমণ্ড হ্যালি নামে এক তরুণ জ্যোতির্বিদ। এ রচনার মধ্যে নিউটন একদিকে যেমন আধুনিক বিজ্ঞানের গোড়াপত্তন করেন, অন্যদিকে বিশ্বের গঠন সম্বন্ধে মানুষের মনের বহু কুসংস্কার দূর করেন। তাঁর প্রতি সমালোচনা করা হল তিনি তাঁর তত্ত্বে বিশ্বপ্রকৃতিকে যেভাবে বিবেচনা করেছেন তা থেকে মনে হয় এ সমস্তই যেন এক বিশৃঙ্খল মনের প্রাণহীন সৃষ্টির কাহিনী ।
নিউটন জবাবে বললেন, প্রকৃতপক্ষে এ বিশ্বপ্রকৃতি এমন সুশৃঙ্খল সুসামঞ্জস্যভাবে সৃষ্টি হয়েছে মনে হয় এর পশ্চাতে সৃষ্টিকর্তার শ্রেষ্ঠ দান রয়েছে। সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে কোন বিতর্ক তিনি সৃষ্টি করেননি। নিউটন সৃষ্টিকর্তা সম্বন্ধে কোন কল্পনা করতেন না।
তিনি বলতেন, আমি বিজ্ঞানী, ধর্মের কোন বিষয় বা সৃষ্টিকর্তা সংক্রান্ত কোন বিষয় আমার গবেষণার অন্তর্ভুক্ত নয়। আমি শুধু সৃষ্ট প্রত্যক্ষ নিয়মের পর্যালোচনা করি । প্রকৃতপক্ষে তিনি নিজের বিরাটতত্ত্বকেই সঠিকভাবে জানতে পারেননি অসাধারণ আবিষ্কারের পরও তিনি ছিলেন অসুখী মানুষ যখন তিনি Principla Mathematica রচনার কাজ করে যান তখন তিনি তাঁর কয়েকজন প্রভাবশালী
বন্ধুর সাহায্যে রাজদরবারের কোন পদ পেতে চেয়েছিলেন। অ্যারিস্টটলের পর তিনি যে পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী, তার প্রকৃত মর্যাদা যে দেশের মানুষ দিতে পারেনি তার জন্যে তিনি সামান্যতম আগ্রহ প্রকাশ করেননি। তাঁর আগ্রহ ছিল ব্রিটেনের রাজার একজন বেতনভুক রাজনৈতিক উপদেষ্টা হওয়ার।
নিউটন এর রাজনীতি
Principia প্রকাশের পরই নিউটন সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে নামলেন। যখন দ্বিতীয় জেমস বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীনতা কেড়ে নিতে চাইলেন, তিনি তখন সক্রিয় বিরোধী হয়ে উঠলেন।
রাজপরিবারের উৎখাতের পর ১৬৯৪ সালে নতুন সংবিধান তৈরির জন্য যে কনভেনশন গড়ে উঠল, নিউটন তার সদস্য হলেন রাজা তাঁর সাথে রাজনীতি বিষয়ে পরামর্শ করতে চাইলে তিনি বলেন, আমি নিউটন রাজনীতিবিদ নয়, দার্শনিক। তবুও' রাজনীতিবিদ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন তিনি। ১৬৯০ সালে কনভেনশনের পরিসমাপ্তি ঘটল, নিউটনের রাজনৈতিক জীবনেরও পরিসমাপ্তি ঘটল।
শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে নিউটন সম্পর্কে গুজব রটতে শুরু করল। প্রচার হতে থাকল তিনি মানসিক রোগে আক্রান্ত। তাঁকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। কিন্তু সবার ধারণা পাল্টে দিয়ে তিনি কিছুদিনের মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠলেন এরপর তিনি টাঁকশালে চাকরি নিলেন।
বিজ্ঞান ছেড়ে তাঁকে মুদ্রার সমস্যায় জড়িয়ে পড়তে হল। নিউটনের সমালোচকের সংখ্যা কম ছিল না। তারা প্রচার করতে লাগল, ট্যাকশালের প্রধান হওয়াই তাঁর জীবনের লক্ষ্য। কিন্তু চাকরির মধ্যেও তার গবেষণা চলতে থাকল। একদিকে মোমবাতি জ্বলছিল ঘরের ককোণায় বসে ছিল নিউটনের শোষা কুকুর ডায়মণ্ড। নিউটন ঘরের বাইরে যেতে ডায়মত লাফ দিল টেবিলের উপর। জ্বলন্ত মোমবাতি উলটে গিয়ে পড়ল কাগজের স্তূপে। কয়েক মুহূর্তে জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে গেল নিউটনের বিশ বছরের সাধনার ফল।
নিউটন তাঁর গবেষণাগারে প্রবেশ করে যখন এ ভয়াবহ দৃশ্য দেখলেন, কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। তাঁর বুঝতে সামান্যতম অসুবিধা হল না এই দুষ্কর্মের নায়ক কে। কিন্তু এতটুকু ক্রোধের চিহ্ন ফুটে উঠল না তাঁর মুখে।
শুধু ডায়মণ্ডের পিঠে সামান্য চাপড় দিয়ে বললেন, ডায়মও, তুমি জান না তুমি কি ক্ষতি করলে। তারপর আবার নিজের কাজে মন দিলেন। টাঁকশালে চাকরি করে নিউটনের আর্থিক দুরবস্থা দূর হল। এ সময় নিজেকে অভিজাত সমাজে প্রতিষ্ঠা করার কাজে উদগ্রীব হয়ে উঠলেন | লন্ডনের সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত পাড়ায় বাড়ি ভাড়া নিলেন। সংসার দেখাশুনার জন্য প্রিয় ভাইঝিকে কাছে নিয়ে এলেন। নিজের বংশমর্যাদা নিয়ে গর্ব করতেন। শহরের বাইরে তাঁর কিছু সম্পত্তি ছিল।
মাঝে মাঝে তিনি সেখানে গিয়ে থাকতেন। যখন কেউ সেখানে যেত, দেখতে পেত গণিতশাস্ত্রের মহা পণ্ডিত গ্রামের লোকদের সাথে তাঁর ভাগের গরু ছাগল ভেড়ার সংখ্যা নিয়ে ঝগড়া করছেন। যিনি সমস্ত জীবন ধরে প্রকৃতির ভাষা পাঠ করতে চেষ্টা করেছেন, তিনিই বিচিত্র ভাষায় ভাইঝির সাথে ঝগড়া করছেন। ১৭০৩ সালে নিউটনের জীবনে এলে এক অভূতপূর্ব সম্মান।
তিনি রয়াল সোসাইটির সভাপতি হলেন। আমৃত্যু তিনি সেই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৭০৫ সালে রানী এ্যানি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে এলেন। রানীর পক্ষ থেকে নিউটনকে নাইটহুড উপাধিতে ভূষিত করা হল। এ সময় ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলাস-এর প্রথম আবিষ্কর্তা হিসেবে জার্মান দার্শনিক লিবনিজের সাথে বিতর্কে জড়িয়ে পড়লেন। ইংল্যান্ডের রয়াল অ্যাকাডেমি জানতে পারে লিবনিজ Differential Calculus-এর আবিষ্কর্তা হিসেবে দাবি জানাচ্ছেন।
রয়াল একাডেমির সদস্যরা ক্রোধে ফেটে পড়ল । তাদের সভাপতির কৃতিত্বকে এক বিদেশী চুরি করে নিজের নামে প্রচার করতে চাইছে। কারণ তারা বিশ্বাস করতেন নিউটনই প্রথম Calculus-এর সম্ভাবনা, তার অস্তিত্ব সম্বন্ধে লিবনিজের কাছে বলেছিলেন। লিবনিজ একে উন্নত করেছে, সঠিক বিস্তৃতি দিয়েছে কিন্তু আবিষ্কার করেনি। ইংল্যান্ডের রয়াল একাডেমির সদস্যরা নিউটনের সপক্ষে প্রচার শুরু করল। জার্মানরাও লিবনিজের পক্ষে বক্তব্য রাখল । দু পক্ষের লড়াই ক্রমশই বাড়তে থাকে। প্রথমে নিউটন এ বিবাদ থামাতে সচেষ্ট হলেন কিন্তু যখন ব্রিটেনের রাজা এ ব্যাপারে মনোযোগ দিলেন, তখন নিউটন নিজের এবং দেশের সম্মানের কথা বিবেচনা করে নিজের সপক্ষে বক্তব্য রাখার জন্য প্রস্তুত হলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে সেই সময় লিবনিজ মারা গেলেন। বিতর্ক তবুও চলতে থাকল এবং সে বিতর্কের কোন মীমাংসা হয়নি। তবে নিরপেক্ষ ঐতিহাসিকদের মতে নিউটন ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলাসের উদ্ভাবক হলেও লিবনিজের পদ্ধতি ছিল অনেক সহজ এবং স্বয়ংসম্পূর্ণ।
আইজ্যাক নিউটন মৃত্যুর পূর্বে যা বলেছিলেন
বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে নিউটন রাজনীতি এবং আভিজাতের বিড়ম্বনা থেকে ক্রমশঃই নিজেকে দূরে সরিয়ে নিতে আরম্ভ করলেন। ১৭২৭ সাল, নিউটন গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। চিকিৎসায় কোন সুফল পাওয়া গেল না। অবশেষে ২০শে মার্চ মহাবিজ্ঞানী নিউটন তাঁর প্রিয় অনন্ত বিশ্বপ্রকৃতির বুকে চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেলেন।
সাত দিন পর তাঁকে ওয়েস্ট মিনিস্টার এ্যাবিতে সমাধিস্থ করলেন। মৃত্যুর কয়েকদিন আগে তিনি লিখেছিলেন, “পৃথিবীর মানুষ আমাকে কি ভাবে জানি না, কিন্তু নিজের সম্বন্ধে আমি মনে করি আমি একটা ছোট্ট ছেলের মত সাগরের তীরে খেলা করছি আর খুঁজে ফিরেছি সাধারণের চেয়ে সামান্য আলাদা পাথরের নুড়ি বা ঝিনুকের খোলা । সামনে আমার পড়ে রয়েছে অনাবিষ্কৃত বিশাল জ্ঞানের সাগর ।
এসা বিডি ডটকম এর নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url